২৩ মার্চ ২০২৩ , ৪:৩২:৫২ প্রিন্ট সংস্করণ
শামিম হোসেন ,নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি:
নওগাঁয় মাদকবিরোধী অভিযানে জব্দকৃত গাঁজা প্রত্যক্ষদর্শীদের না দেখিয়ে অভিযানের সময় ও স্থান পাল্টে ফেলার অভিযোগ উঠেছে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক লোকমান হোসেন এর বিরুদ্ধে। গত ১৩ মার্চ বিপুল পরিমাণ গাঁজা জব্দের পর সেটিকে ৪৯ কেজি দেখাতে এমন অপকৌশল বেঁছে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তার যোগসাজসে প্রকাশ্য এই অনিয়ম ক্ষতিয়ে দেখতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন আইন বিশ্লেষকরা।
নওগাঁ সদর মডেল থানায় দায়েরকৃত এজাহার অনুযায়ী, গত ১৩ মার্চ সকাল সাড়ে ৭টায় জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক লোকমান হোসেনসহ ১১জনের একটি অভিযানিক দল মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনায় অফিস থেকে গাড়ীযোগে রওনা হোন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শহরের বরুনকান্দি এলাকায় অতিথি ফিলিং স্টেশন এর সামনে অবস্থান নিয়ে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে হাঁপানিয়াগামী একটি মাইক্রোবাস থামিয়ে তল্লাশী করেন তারা। ওই মুহুর্তে মাইক্রোবাসে থাকা চালক, এক নারীসহ ৬জনকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে গাড়ী থেকে ৪৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়। সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে মাইক্রোবাস ও ৪৯ কেজি গাঁজার জব্দ তালিকা প্রস্তুত করে স্বাক্ষী হিসেবে প্রত্যক্ষদর্শী ৩জনের স্বাক্ষর নেওয়া হয়। পরে রাত সাড়ে ১০টায় সদর মডেল থানায় বাদী হয়ে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) সারণির ১৯(গ)/২৬(১)/৪১ ধারায় মামলা করেন উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল্লা হিল বাকী।
অনুসন্ধানে নওগাঁ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই মামলার বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। এজাহারে শহরের বরুনকান্দি এলাকায় অতিথি ফিলিং স্টেশন এর সামনে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে অভিযানের সময় উল্লেখ করলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই অভিযান পরিচালনা করা হয় ওইদিন ভোর ৪টা থেকে সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যেই শহর বাইপাস ব্রীজ সংলগ্ন রামভদ্রপুর ও ইকরতারাগামী রাস্তার উপর। ওই মুহুর্তে রাস্তা সংলগ্ন দোকানের ভেতরে ঘুমিয়েছিলেন মুদি দোকানী শাহীন হোসেন। ভোর ৪টায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানিক দলের কথার শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। শাহিনের দোকানের ১টি টুলবেঞ্চ দিয়ে রাস্তায় বেরিগেট দেন তারা। সেখানে প্রথমে সন্দেহমূলকভাবে একটি ট্রাক থামিয়ে তল্লাশী চালানো হয়। পরবর্তীতে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ওই পথ হয়ে রাজশাহী অভিমুখে যাওয়া একটি মাইক্রোবাস থামানো হয়। যেখানে মাইক্রোবাসের ভেতরে থাকা চালকসহ ৬জনের কথাবার্তা সন্দেহজনক হওয়ায় তাৎক্ষণিক তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গাড়িতে গাঁজা পরিবহণের কথা স্বীকার করেন তারা। ওই মুহুর্তে গাড়ির ভেতরে তল্লাশীর সময় বিপুল পরিমাণ গাঁজা দেখতে পাওয়া যায়। তবে ততক্ষণে সূর্যের আলোতে চারিদিক আলোকিত হওয়ায় উৎসুক জনতাসহ অভিযানের শুরুর প্রত্যক্ষদর্শীরা ভীড় জমায়েত করেন। ওই মুহুর্তে স্থানীয়রা উদ্ধারকৃত গাঁজা দেখতে চাইলে তা না দেখিয়ে সকাল সাড়ে ৬টার মধ্যে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানিক দলের সদস্যরা।
ওই এলাকা থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বরুনকান্দি এলাকার অতিথি ফিলিং স্টেশন। মাত্র ৩ মিনিটের ওই পথ পৌঁছাতে ব্যয় করা হয় প্রায় ১ ঘন্টারও বেশি সময়। গাঁজাসহ ৬জন আটকের খবরটি তড়িঘড়ি করে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মুঠোফোনে জানানো হয়। সেখানে সাংবাদিকরা উপস্থিত হওয়ার পর অতিথি ফিলিং স্টেশন এর সামনে দাঁড়িয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক লোকমান হোসেন। মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার কেটে তার ভিতরে ও মাইক্রোবাসের বডির ভেতরে অভিনব কায়দায় রাখা ৪৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেননি এমন ৩জনের থেকে স্বাক্ষী হিসেবে জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর নেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রামভদ্রপুর ও ইকরতারা গ্রামের একাধিক বাসিন্দা বলেন, সাদা রঙের মাইক্রোবাস পথরোধ করে আটকের পরই ভেতরে থাকা আরোহীরা গাঁজা বহনের কথা স্বীকার করেছিলো। তল্লাশীর সময় গাড়ীতে বিপুল পরিমাণ গাঁজা আমরা দেখেছি। কমপক্ষে ১শ কেজি হওয়ার কথা। ৩০ জনেরও বেশি লোক এখানে জমায়েত হয়েছিলো। এরমধ্যে মুসল্লীর সংখ্যাই বেশি। জব্দকৃত গাঁজা পরিমাপ করে দেখাতে বললে তারা কৌশলে এখান থেকে চলে যায়। পরে শুনছি ৪৯ কেজি উদ্ধার দেখানো হয়েছে।
অভিযানের শুরু থেকে শেষ অবধি দেখেছেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে মামলার স্বাক্ষী বাহাদুর আলী, জাহিদুল ইসলাম এবং আজম বাবু বলেন, গাঁজাসহ গাড়ীটি কোত্থেকে প্রথমে আটক করেছিলো তা জানা নেই। তবে গাড়িটি শহরের বাইপাস ব্রীজ এর সড়ক হয়ে এখানে আনা হয়েছিলো। আটককৃতদের আশেপাশে স্থানীয়দের যেতে দেয়া হয়নি। হাতকড়া পড়া অবস্থায় গাড়িসহ তাঁদের এনে পেট্রোল পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে ৪৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার দেখিয়ে আমাদের থেকে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে।
মামলার বাদী উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল্লা হিল বাকী বলেন, অভিযানিক দল সকাল সাড়ে ৭টায় রওনা হওয়ার প্রমাণ অফিসের সিসিটিভি ফুটেজে সংরক্ষিত আছে। ভোর থেকে বাইপাস ব্রিজ এলাকায় আমরা অবস্থান নেয়নি। এ সংক্রান্ত বক্তব্য গণমাধ্যমকে দেওয়া নিষেধ আছে বলেও জানান তিনি।
অভিযানে অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক লোকমান হোসেন বলেন, পুরো অভিযানের শুরু থেকে আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম। অভিযানের সময় ও স্থান পাল্টে ফেলার সুযোগ নেই। প্রত্যক্ষদর্শীদের সামনেই গাঁজাগুলো উদ্ধার করে স্বাক্ষীদের জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। অভিযোগগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবী করেন তিনি।
শহরের ভেতরে অভিযান হওয়া সত্বেও আটকদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক মামলা না করে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নিজেদের কাছে রাখাটা কতটা যৌক্তিক? এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান তিনি।