নারায়ণগঞ্জ

যুব সমাজের জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে না পারার কারণ ও তার প্রতিকার

*যুব সমাজের জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে না পারার কারণ ও তার প্রতিকার*
মোঃ নাজিম মিয়া
স্টাফ রিপোর্টার
কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার)

মানুষের জীবন একটি যাত্রা, যেখানে লক্ষ্য স্থির না থাকলে গন্তব্যে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। লক্ষ্য হচ্ছে সেই দিকনির্দেশনা, যা একজন মানুষকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং তার জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। তবে অনেক যুবক-যুবতী তাদের জীবনে একটি স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে তারা সময় ও সম্ভাবনা অপচয় করে এবং হতাশায় ডুবে যায়।

জীবনের লক্ষ্যহীনতা কেবল ব্যক্তির মানসিক শান্তি নষ্ট করে না, বরং এটি তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। লক্ষ্যহীন মানুষ একটি নৌকার মতো, যা বাতাসের দিকনির্দেশনায় এদিক-সেদিক ভেসে বেড়ায়, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না।

যুব সমাজের জন্য জীবনের লক্ষ্য স্থির করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ্যহীনতা তাদের সম্ভাবনাগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। সঠিক দিকনির্দেশনা এবং লক্ষ্য স্থির করার কৌশল জানা না থাকলে তাদের জীবনের অর্থ এবং উদ্দেশ্য ধোঁয়াশায় ঢাকা পড়ে যায়। তাই জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে না পারার কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং তা কাটিয়ে উঠার উপায় জানা প্রত্যেকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

যুবক-যুবতীরা জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে না পারার পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ কাজ করে। এ সমস্যাগুলো তাদের জীবনের গতি ও সাফল্যকে বাধাগ্রস্ত করে। নিচে প্রতিটি কারণ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

*১. স্ব-পরিচিতির অভাব:*

নিজেকে না চেনা বা নিজের প্রতি সচেতনতার অভাব জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে বড় বাধা। অনেকেই জানে না তাদের শক্তি, দুর্বলতা, বা পছন্দগুলো কী। “আমি কী পারি?” বা “আমি কী করতে ভালোবাসি?”—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না জানলে সঠিক দিক নির্ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এটি সাধারণত ঘটে যখন মানুষ নিজের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় কাটায় না। তারা শুধু বাহ্যিক চাহিদা পূরণেই ব্যস্ত থাকে। নিজের যোগ্যতা আবিষ্কার করতে না পারার ফলে তারা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, যা জীবনে হতাশা ও সময়ের অপচয়ের কারণ হয়।

*২. অগ্রাধিকারের অভাব:*

অনেকেই জীবনে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে পারে না। ফলে তাদের লক্ষ্য অস্পষ্ট থাকে। উদাহরণস্বরূপ, একজন যুবক একই সময়ে একটি পেশা, পরিবার, এবং বন্ধুদের মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
অগ্রাধিকার স্থির করতে না পারলে তারা কোনো একটি কাজেই পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারে না। এটি তাদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে ব্যর্থতার কারণ হয়। তাই জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।

*৩. পরিবার ও সমাজের চাপ:*

অনেক যুবক-যুবতী তাদের পরিবারের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে নিজের স্বপ্নকে ভুলে যায়। সমাজের নিয়ম বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে তুলনা করাও তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছাগুলোকে ধ্বংস করে দেয়।
যেমন, অনেকেই নিজের আগ্রহের পেশা বেছে নিতে পারেন না, কারণ পরিবার বা সমাজ তাদের থেকে অন্যকিছুর প্রত্যাশা করে। এই চাপ তাদের নিজের লক্ষ্য নির্ধারণে বাধা সৃষ্টি করে এবং জীবনে সন্তুষ্টি আনতে ব্যর্থ হয়।

*৪. পর্যাপ্ত তথ্য বা দিকনির্দেশনার অভাব:*

জীবনের সঠিক লক্ষ্য স্থির করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য থাকা জরুরি। কিন্তু অনেক যুবক জানে না তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে।
যেমন, একজন শিক্ষার্থী যে চিকিৎসক হতে চায়, সে যদি প্রয়োজনীয় শিক্ষা বা ক্যারিয়ার সম্পর্কিত তথ্য না জানে, তবে তার পক্ষে সেই লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন। মেন্টর বা গাইডের অভাবে এ ধরনের সমস্যাগুলো আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

*৫. প্রত্যাশার উচ্চ চাপ:*

বড় কিছু অর্জনের চাপ অনেকের মনোবল ভেঙে দেয়। জীবনের শুরুতেই বড় কিছু করার ইচ্ছা তাদের ভীত করে তোলে। যেমন, অনেকেই মনে করে যে তারা যদি সফল না হয়, তবে সমাজ বা পরিবার তাদের মূল্যায়ন করবে না।
এই চাপ তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেয়। ফলে, তারা নতুন কোনো উদ্যোগ নিতে সাহস করে না এবং নিজেদের লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যর্থ হয়।

*৬. স্বল্পমেয়াদি চিন্তা:*

অনেক যুবক স্বল্পমেয়াদি লাভের কথা ভেবে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যকে এড়িয়ে চলে। এটি তাদের জীবনে অস্থিরতা তৈরি করে।
উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি পড়াশোনার পরিবর্তে দ্রুত আয় করার জন্য একটি ছোট চাকরি বেছে নেয়, তবে দীর্ঘমেয়াদে সে তার জীবনের বড় লক্ষ্য হারিয়ে ফেলতে পারে। ধৈর্যের অভাব এবং অবিলম্বে ফল পাওয়ার ইচ্ছা তাদের লক্ষ্য অর্জনে বড় বাধা।

*লক্ষ্য স্থির করার উপায়*

*১. নিজেকে জানুন* :

নিজের শক্তি, দুর্বলতা, এবং আগ্রহ চিহ্নিত করা জীবনের লক্ষ্য স্থির করার প্রথম ধাপ। প্রতিদিন নিজের কাজ, পছন্দ এবং অর্জন নিয়ে চিন্তা করুন।
নিজেকে প্রশ্ন করুন: “আমি কীসে ভালো?” বা “আমি কী করতে পছন্দ করি?” ছোট ছোট কাজ বা প্রকল্প নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুন। এটি আপনাকে নিজের আগ্রহের বিষয়গুলি চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।

২. *দীর্ঘমেয়াদি এবং স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করুন:*

একটি বড় লক্ষ্য অর্জন করতে হলে তা ছোট ছোট ধাপে ভাগ করতে হবে। যেমন, যদি আপনার লক্ষ্য একজন চিকিৎসক হওয়া হয়, তবে তার জন্য প্রথমে ভালোভাবে পড়াশোনা, তারপর নির্দিষ্ট পরীক্ষা পাস করা এবং তারপর অভিজ্ঞতা অর্জন করা প্রয়োজন।
দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য মানেই এমন কিছু যা আপনার জীবনে স্থায়ী পরিবর্তন আনবে। স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য সেই বড় লক্ষ্য অর্জনের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

*৩. SMART নিয়ম অনুসরণ করুন:*

Specific: আপনার লক্ষ্যকে নির্দিষ্ট করুন, যেমন “আমি একজন শিক্ষক হতে চাই।”
Measurable: লক্ষ্য পূরণের অগ্রগতি মাপুন, যেমন “আমি প্রতি মাসে একটি দক্ষতা অর্জন করব।”
Achievable: লক্ষ্য বাস্তবসম্মত হতে হবে।
Relevant: লক্ষ্য আপনার জীবনের উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।
Time-bound: একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করুন, যাতে লক্ষ্য পূরণে সময়মতো এগোনো যায়।

*৪. মেন্টর খুঁজুন:*

একজন মেন্টর বা পথপ্রদর্শক জীবনের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে। তারা আপনাকে আপনার সম্ভাবনা আবিষ্কার করতে এবং সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
যেমন, যদি আপনি উদ্যোক্তা হতে চান, তবে একজন সফল উদ্যোক্তার সঙ্গে আলোচনা করুন। তার পরামর্শ আপনার সময় ও শক্তি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে সাহায্য করবে।

*৫. একাগ্রতা এবং ধৈর্য বজায় রাখুন:*

লক্ষ্য অর্জনের পথে ব্যর্থতা আসবে, কিন্তু এতে হতাশ হওয়া উচিত নয়। বরং এটি থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
ছোট ছোট সফলতাগুলো উদ্‌যাপন করুন। এটি আপনাকে আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করবে।

🔹 *বাস্তব উদাহরণ*

*স্টিভ জবস (Apple-এর প্রতিষ্ঠাতা):*

স্টিভ জবস বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি প্রযুক্তির প্রতি তার আগ্রহকে বড় করে দেখতে চেয়েছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল এমন কিছু তৈরি করা যা মানুষের জীবন সহজ করে দেবে। সেই লক্ষ্যই তাকে Apple প্রতিষ্ঠায় সফল করেছে।

*মুস্তাফা কামাল (বাংলাদেশের সফল উদ্যোক্তা):*

মুস্তাফা কামাল জীবনের শুরুতে কঠিন সময় পার করেছিলেন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখা। সেই লক্ষ্যই তাকে বসুন্ধরা গ্রুপ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।

*উপসংহার*

জীবনের লক্ষ্য স্থির করা সময়সাপেক্ষ, তবে এটি আপনার জীবনের সাফল্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সঠিক পরিকল্পনা, ধৈর্য, এবং আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে যে কেউ নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। নিজের ইচ্ছা এবং সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই সফলতার মূল চাবিকাঠি।
লেখক, তামভীর রায়হান ওয়াসিম

শেয়ার করুন:

আরও খবর

Sponsered content